তুর পাহাড়

‘তুর পাহাড়ের দেশে’
‘তুর পাহাড়ের দেশে’ মূলত একটি উর্দু রিসালার ভাষান্তর। এই রিসালাটি নকশাবন্দী সাহেবের লিখিত কোন রিসালা নয়, জাম্বিয়া সফরের এক বয়ানে তিনি তুর পাহাড়ের সফরনামার বর্ণনা দেন; মূল রিসালাটি সেই বয়ানের শ্রুতিলিখন। সংকলন করেছেন মাওলানা সালাহুদ্দিন সাইফি নকশাবন্দী। এই সফরনামায় সফরের খুঁটিনাটির বর্ণনা নেই যদিও, কিন্তু সফরের ধারাবাহিতা ও আল্লাহ প্রেমের সন্ধানে ছুটে চলা এক আশিক বান্দার ‘আজীব হালত’ এর বর্ণনা রয়েছে; যা পাঠককে বিস্মিত করবে। আল্লাহর ওপর কীভাবে তাওয়াককুল করতে হবে! কীভাবে দুআকে কবুল করিয়ে নিতে হবে! সবই জানা যাবে সফরনামার পাতায়। ইনশাআল্লাহ।

Description

‘তুর পাহাড়ের দেশে’
‘তুর পাহাড়ের দেশে’ মূলত একটি উর্দু রিসালার ভাষান্তর। এই রিসালাটি নকশাবন্দী সাহেবের লিখিত কোন রিসালা নয়, জাম্বিয়া সফরের এক বয়ানে তিনি তুর পাহাড়ের সফরনামার বর্ণনা দেন; মূল রিসালাটি সেই বয়ানের শ্রুতিলিখন। সংকলন করেছেন মাওলানা সালাহুদ্দিন সাইফি নকশাবন্দী। এই সফরনামায় সফরের খুঁটিনাটির বর্ণনা নেই যদিও, কিন্তু সফরের ধারাবাহিতা ও আল্লাহ প্রেমের সন্ধানে ছুটে চলা এক আশিক বান্দার ‘আজীব হালত’ এর বর্ণনা রয়েছে; যা পাঠককে বিস্মিত করবে। আল্লাহর ওপর কীভাবে তাওয়াককুল করতে হবে! কীভাবে দুআকে কবুল করিয়ে নিতে হবে! সবই জানা যাবে সফরনামার পাতায়। ইনশাআল্লাহ।
বইটিতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও তত্ত্ব পেশ করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ তথ্যর মধ্যে দুইটি ঘটনা আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি।
অনেক চড়াই উত্তরাই পেরিয়ে হযরতজী যখন তূর পাহাড়ের ”শাজারে তাজাল্লির ছায়ায়” বসে মুরাকাবাতে বসেন। মুরাকাবা শেষ করে যখন হযরতজী উঠে দাড়ান, তখন দেখেন একজন কর্নেল তাদের সামনে দাড়ানো। সেই কর্নেল সেন্ট ক্যাথরিনের সিকিউরিটি স্টাফের প্রধান ছিলেন। আল্লাহতালার মেহেরবানিতে, কিছুক্ষণের মধ্যে কর্নেলের সংগে হযরতজীর আন্তরঙ্গ হয়ে যান। যার ফলে বিভিন্ন জায়গা দেখার সৌভাগ্য লাভ সহজ হয়ে যায়। নিচে তেমনি দুইটা ঘটনা তুলে ধরলাম।
এক প্রাচীন গৃহ:
সেন্ট ক্যাথরিনের সিকিউরিটি স্টাফের প্রধান (কর্নেল) বললেন একজন সাহাবী উমর ইবনুল আস
রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এখানে এসেছিলেন। যিনি মিশর বিজয় করেছেন। তারা গির্জার পাশেই একটি মসজিদ নির্মাণ করেছে। এই মসজিদটি এখনো আছে। তবে পাদ্রীরা ক্ষমতার বলে গির্জা ইত্যাদি দখল করে রেখেছে। এবং তারা (মসজিদটি) বন্ধ করে দিয়েছে। কেউই ওখানে যেতে পারে না। মসজিদ তো স্বীয় জায়াগাতেই বিদ্যমান কিন্তু তা তালাবদ্ধ। তাতে প্রবেশ করা ও নামায পড়া নিষিদ্ধ। তারা ঐ (মসজিদের) দরজা বন্ধ করে রাখে।
কর্নেল যখন আমাদের এসব বললো, তখন আমাদের ইচ্ছা হলো আমরা যদি ঐ মসজিদে যেতে পারতাম, যে মসজিদ সাহাৰী নির্মাণ করেছেন। না জানি আমাদের কত আকাবির এখানে এসেছেন। কর্নেল বলতে লাগলো, আপনারা সৌভাগ্যবান। মসজিদের পাশে কিছু মেরামত ও নির্মাণ কাজ চলছে। এবং সিমেন্ট-ইট ইত্যাদি নেয়ার জন্য শ্রমিকরা আসা যাওয়া করছে। ঐ যে সামনে লোহার দরজা আপনারা দেখছেন, তার তালা আজ খোলা আছে। তো শ্রমিকরা যায় আর দরজাকে বন্ধ করে দেয়। এসে আবার খুলে। পরে বন্ধ করে দেয়। তো আপনারা যান। যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, আপনারা এখানে কেন এসেছেন? তবে বলবেন, দরজা খোলা দেখে আমরা ভিতরে প্রবেশ করেছি। সুবহানাল্লাহ! যে ওখানের নিরাপত্তাকর্মী সেই আমাদের পথ দেখাচ্ছে। সে দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা দরজা খোলা দেখে স্বস্তিতে ভিতরে প্রবেশ করলাম।
আমরা ছিলাম তিনজন। চতুর্থজন ছিল আমাদের গাইড। সে অনেক খুশি যে, তারও আজ ভিতরে প্রবেশ করার সুযোগ এসে গেল। আমরা মসজিদ দেখলাম। মসজিদটি অতো বড় নয়। দরজা বন্ধ ছিল তবে আয়না দিয়ে ভিতরের সবকিছু দেখা যাচ্ছিল। আমি সাথীদের বললাম, ভাইয়েরা চাশতের সময় হয়ে গেছে। ওজুও আছে। মন চাচ্ছে দু’রাকাত নামায পড়ে নেই! গাইড বললো, তাদের পাদ্রীরা এখানে ঘুরাফেরা করে। যাদি তারা দেখে আমরা ভিতরে এসেছি ও নামাযও পড়ছি, তবে বিষয়টি জটিল হয়ে যাবে। আমি বললাম, আমি তো নামায পড়বোই। গাইড বললো কীভাবে? বললাম, এটার পদ্ধতি আমি বলছি। আপনারা তিনজন মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে পরস্পর গল্প
করুন। আপনাদের পিছনে আড়ালে আমি দু’রাকাত নামায পড়বো। তারা এমনই করলো। আল্লাহর কী মহিমা! আমি এক রাকাত নামায পড়েছি আর উপর থেকে এক পাদ্রী আসছিল। মনে হলো সে ভিডিও-র মাধ্যমে নেগরানি (পর্যবেক্ষণ) করছিল। সে আমাদেরকে মসজিদের দরজাতেই দেখেছিল। সে আসলো এবং আমাকে সিরিয়াস মুডে দেখতে লাগলো। আমাদের সাথীরা তো ঘাবড়ে গিয়েছিল যে, সে তো এখন আমাদের ধরবে আর বলবে ‘গেট আউট’। কিন্তু এখনো আমাদের অনেক কিছু দেখা বাকী! যাইহোক, আমরা আল্লাহর কাছে দুআ করলাম ও বেরিয়ে আসলাম। বাহিরে এসে দেখলাম ঐ কর্নেল এখনো তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আমরা তাকে বললাম ভাই, আমরা দেখে এসেছি,
নামাযও পড়েছি। সে মুচকি হাসলো আল্লাহর শান দেখুন, তিনি কীভাবে মানুষের অন্তরে ভালোবাসা ঢেলে দেন! সে আমাদের বললো, আপনারা কি শাজারে তাজাল্লির পাতা নিতে পছন্দ করবেন? আমরা বললাম কেন নয়? সে নিজ থেকে বললো, আপনাদের কি জানা নেই যে, তাতে নিষেধাজ্ঞা আছে? অতঃপর সে বললো, আমি আপনাকে দিব। এর আগে আপনারা প্রথমে যে বেঞ্চের উপর বসেছিলেন, তাতে বসে পড়ুন। পরে তা আপনাকে দিব। একটি বিষয় আমরা প্রথমে বুঝিনি, পরে জানতে পারলাম আসল ঘটনা হয়েছে যে, আমরা তো সেই নুরের তাজাল্লির গাছের ওখানে গিয়ে বসে পড়ি এবং মুরাকাবা শুরু করে দেই। আমরা যখন মুরাকবা করছি, তখন ঐসব দর্শনার্থীরা যারা ঘুরাফেরা করছিল, তারা শাজারে তাজাল্লির দু-তিনটি ছবি তুলে, আমাদের ছবি তুলতে শুরু করেছিল। আর আমাদের আশেপাশে ভিড় লেগে গিয়েছিল। তা ক্যামেরার মাধ্যমে কর্নেল দেখছিল, যে এইসব মানুষ কোন জিনিসের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে? শাজারে তাজাল্লি তো ঐদিকে। তাদের ক্যামেরা আবার এদিকে চলছে। তো, সে এসব দৃশ্য ক্যামেরার মাধ্যমে দেখছিল, যা আমরা বুঝতে পারিনি। আমরা তাে মুরাকাবায় লিপ্ত ছিলাম। মুরাকাবা শেষ হবার পর দেখলাম, আমাদের সামনে এক মহিলা। তার স্বামী তার ছবি তুলছে। আরেকদিকে একলোক দাঁড়িয়ে আছে। তার স্ত্রী তার ছবি তুলছে। তাদের জীবন তো এরকমই। আমরা কর্নেলকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আমাদের কেন বসতে বললেন? তখন সে বললো, এই গাছের পাশে সবসময় প্রায় পাঁচশ মানুষ থাকে। যদি কেউ দেখে ফেলে যে, কেউ পাতা ছিড়ছে; তবে তার শাস্তি হয়। তো আমি কি ভাবে মানুষের সামনে পাতা ছিড়বো তো লোকেরা যখন আপনার ছবি তুলতে ব্যস্ত ছিল, তখন গাছের একটা দিক খালি হয়ে যায়। আর এই ফাঁকে আমি কিছু পাতা ছিড়ে ফেলি। সে পাঁচ-ছয়টা পাতা আমাদের ধরিয়ে দেয়। অতঃপর আমরা শাজারে তাজাল্লিতে আল্লাহর নিকট দুআ করি।

আমি আমার সাথীদের বললাম, এই জায়গাতে আল্লাহকে আমাদের এটা বলা উচিত যে, “হে আল্লাহ! এই জায়গা শুধু একটা বন-জঙ্গল ছিল। আপনি সেখানে আপনার তাজাল্লিসমূহ ঢেলে দিয়েছেন। আমরা ময়লা অন্তর নিয়ে এসেছি, আপনি তাতে তাজাল্লি ঢেলে দিন।” এই জায়গাটি নুর ও প্রশান্তিময় ছিল।

দ্বিতীয় ঘটনা

একটি ইতিহাস:
আমরা পরে জানতে পারলাম যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে এখানে যেসব পাদ্রী ছিল, তারা মদীনায় গিয়ে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললো, আমাদের ঐ জায়গাতে যদি কখোন আপনার ধর্ম পৌঁছে যায়, তবে ঐ জায়গা যেন আমাদেরই থাকে। আপনি আমাদের আমান-নামা (নিরাপত্তাপত্র) লিখে দিন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আহলে কিতাবকে সম্মান করতেন। তাদের মন জয় করার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের ‘আমান-নামা’লিখে দেন। তারা সেই আমান- নামাকে একটা মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করে রেখেছে। তাতে হযরত উমর ও আলী রাদিআল্লাহু আনহুমার দস্তখতও আছে। গাইড আমাদের এসব তথ্য দিল। তারা ঐ মিউজিয়াম উপরে বানিয়েছে। এটি বিশেষ জায়গা , এজন্য সবাইকে ওখানে যেতে দেয় না। যারা যাচ্ছিল, তাদের থেকে পঞ্চাশ ডলার ফি নিচ্ছিল। আর তরা তো এসেছে মূলত হজ্বের জন্যে, কূপের পানি পান করো, গাছের হৰি উঠাও, মিউজিয়াম দেখে এবং চলে যাও। এজন্য তাদের কাছে পঞ্চাশ ডলার আদায় করা কোন ব্যাপারই ছিল না।যদি দুইশ মানুষ হয়, আর মিউজিয়ামে প্রবেশের জন্য পঞ্চাশ ডলার নেয়া হয়, তবে তো মোট দশ হাজর মুদ্রা হয়। অতঃপর আমরা বুঝতে পারলাম পুরে গির্জার খরচ এই মউজিয়াম থেকেই আসে। তাদের কর্মচারী, গাড়ি-ঘোড়া, তাদের রাজকীয় জীবনযাপন; সবকিছু খরচ আসয়ো এই মিউজিয়াম থেকে। মিউজিয়ামের ওখানে দীর্ঘ একটি লাইন ছিলো। আমরাও সেই লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। যখন লাইন ধরে আমর দরজার নিকট আসলাম, দরজার ভিতরে পাদ্রী বসা ছিল। সে সম্ভবত কোন ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছিল। সে দেখতে এবং বলতো, অমুককে ভিতরে ঢুকাও। যখন আমাদের বেলা আসলো, তখন আমাদের তিনজন কে একদিকে বই-পস করে দেয়। আর আমাদের পিছনে ইংরেজ লোকদের ডেকে ডেকে ভিতরে নিয়ে নেয়। দরজায় যে লোক ছিল, সে ছিল মিশরি। আমরা তাকে বললাম, আমাদের ভিতরে যেতে দিচ্ছেনা কেন? সে বললো, এখনো অনুমতি নেই। আপনারা অপেক্ষা করুন। আমাদের পনের বিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হলো। এরই মধ্যে আমাদের সাথীরা দুইবার বললো, চলুন! চলে যাই। তারা আমাদের ভিতরে প্রবেশ করতে দিবেনা। আমি বললাম, আরেকটু দাঁড়িয়ে থাকি। পনের বিশ মিনিট পর পাদ্রী আমাদের ভিতরে ডাকলো সে আমাদের জিজ্ঞেস করলো, আপনারা কে? আমরা বললাম, আমরা পাকিস্তান থেকে এসেছি। জিজ্ঞেস করলো, কেন এসেছো? আমরা বললাম, আমরা দেখার জন্য এসেছি। সে আমাদেরকে দুচারটি প্রশ্ন করলো এবং আমাকে বারবার বললো, আপনি কে? আমিও বারবার তাকে বললাম, আমি একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। সে আমাদেরকে টিকেট তো দিল, কিন্তু সে চিন্তায় পড়ে গেল। যখন আমরা অনুমতি পেলাম, তখন ভিতরে প্রবেশ করলাম। আমরা ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখলাম, সেখানে পর্যাপ্ত বিস্ময়কর ও অবাক করা জিনিসের সংগ্রহ ছিল। আল্লাহর শান দেখুন, আমরা যখন সবকিছু দেখে ফিরছিলাম, তখন সে পাদ্রী আমাদের এক সাথীকে ডেকে নিয়ে বললো, এই লোকটা কে? সে বললো, তিনি আমাদের টিচার। সে লোকটা নিজ থেকে বললো, সে তো নিজেকে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। আমাদের সাথী বললো, তিনি আমাদের টিচার। তিনি ইঞ্জিনিয়ারও। সে বললো, আমি আপনাদের ফি ব্যাক করে দিচ্ছি। আপনারা বিনা খরচে সবকিছু পরিদর্শন করুন। আমাদের সাথী অনেক খুশি হয়ে ফিরে আসলো ও বললো, হযরত! লােকটা আমাদের ফি ফেরত দিয়েছে। আমি বললাম, আসল ব্যাপার হচ্ছে, এটা সেই পাদ্রী যে আমাকে নামায পড়তে দেখেছিল। দীর্ঘ সময় পরে এই স্থানে কাউকে নামায পড়তে দেখেছে। আর যখন সে এই দৃশ্য দেখলো, তার অন্তর অনুভব করলো যে, এই জায়গার কোন প্রকৃত উত্তরাধিকারী হয়ত এখানে এসেছে। এ কারণে সে চাচ্ছিল, আমি তার থেকে ফি নিব না। ফি ছাড়াই সবকিছু দেখাবো। যাইহোক, আমরা বের হলাম আর কর্নেল সাহেব আমাদেরকে বোতল ভরে পানি দিলেন। যে কূপের নাম “মুসার কূপ”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *